কী কারণে এত চুল পড়ছে
দিন দিন মাথার চুল পাতলা হয়ে যাচ্ছে,
ঝরে যাচ্ছে, টাক পড়ে যাচ্ছে—এমন কথা অনেকের মুখেই শোনা যায়। চুল পড়া, চুল উঠে যাওয়া বা চুল পাতলা হয়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তার অন্ত নেই। ছেলেমেয়ে সবাই এর শিকার। চুল কেরাটিন নামের
একরকম প্রোটিন দিয়ে তৈরি হয়। চুলে ৯৭ ভাগ প্রোটিন ও ৩ ভাগ পানি রয়েছে। চুলের যেটুকু আমরা
দেখি সেটি মৃত কোষ। কারণ এতে অনুভূতিশীল কোনো কোষ নেই। চুল প্রতি মাসে আধা ইঞ্চি করে বড় হয়। স্বাভাবিকভাবে একটি চুল দুই থেকে চার বছর
পর্যন্ত বড় হতে থাকে। এরপর বৃদ্ধি কমে যায়। গ্রীষ্মকালে চুল দ্রুত বড় হয় কিন্তু শীতকালে কম বড় হয়। একটি চুলের গড় আয়ু
দুই-আট বছর। সুতরাং চুল কিছু না কিছু প্রতিদিন স্বাভাবিকভাবেই ঝরে যায়।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের
চর্ম ও যৌন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক রাশেদ মো. খান বলেন, সাধারণত খুশকি, অ্যান্ড্রোজেনিক হরমোন, দুশ্চিন্তা ও চুলে বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী ব্যবহার করার জন্য
চুল পড়ে থাকে।
কীভাবে বুঝবেন চুল পড়ছে?
একজন সুস্থ মানুষের মাথায় গড়ে এক থেকে দেড়
লাখ চুল থাকে। প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০টা পর্যন্ত চুল পড়া স্বাভাবিক। কিন্তু এর চেয়ে বেশি পড়লে তা অবশ্যই উদ্বেগের
কারণ। বালিশ, তোয়ালে বা চিরুনিতে লেগে থাকা চুল গুনতে চেষ্টা করুন। অন্তত পরপর তিন দিন। অথবা অল্প এক গোছা
চুল হাতে নিয়ে হালকা টান দিন। যদি গোছার চার ভাগের এক ভাগ চুলই উঠে আসে, তবে তা চিন্তার বিষয়।
কী কী কারণে চুল বেশি পড়তে পারে?
* •অ্যান্ড্রোজেনিক হরমোন নারীর চুল পড়া ও পুরুষের
টাকের সবচেয়ে বড় কারণ। এই হরমোন সাধারণত পুরুষের শরীরে বেশি পরিমাণে থাকে। যাদের শরীরে এই হরমোনের প্রভাব বেশি,
তাদেরই বেশি করে চুল পড়ে। নারীর মেনোপজের সময় ও পরে অ্যান্ড্রোজেনিক
হরমোন আনুপাতিক হারে বেড়ে যায়। তখন হঠাৎ চুল বেশি করে পড়তে শুরু করে।
* ছত্রাক সংক্রমণ বা খুশকি হলো চুল পড়ার অন্যতম
কারণ। সে ক্ষেত্রে ছত্রাকরোধী
শ্যাম্পু চুলে ব্যবহার করতে হয়। এর জন্য ওষুধ খেতে হতে পারে। সংক্রমণ ভালো হয়ে গেলে চুল আবার গজায়।
*•শরীরের পুষ্টির ওপর চুলের স্বাস্থ্য নির্ভর
করে। দৈনিক খাদ্যতালিকায়
আমিষ, শর্করা, চর্বি, খনিজ ও ভিটামিন পরিমিত পরিমাণে না থাকলে চুল
পড়ে যায়। এ ছাড়া শরীরে দীর্ঘদিন কোনো একটি উপাদানের অভাবে চুল পড়ে যায়।
* দুশ্চিন্তায় ভুগলে বা মানসিক সমস্যা থাকলে
স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চুল পড়তে পারে। এমনকি টাক হওয়ার চিন্তায় নাকি টাক হয়। তবে এ চুল পড়া সাময়িক এবং পুনরায় চুল গজায়। তবে দীর্ঘদিন মানসিক
দুশ্চিন্তায় থাকলে বা দুশ্চিন্তা কাটিয়ে উঠতে না পারলে অনেক বেশি চুল পড়ে যেতে পারে।
* হরমোনের কমবেশি হওয়ার কারণে চুল উঠে যেতে
পারে। যেমন: থাইরয়েড হরমোনের
মাত্রা কম বা বেশি হলে, গর্ভবতী অবস্থায় এবং
বাচ্চার জন্মের পর হরমোনাল ভারসাম্য পরিবর্তিত হয় বলে তখন চুল বেশি পড়ে। হরমোনের এ পরিবর্তন
আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেলে পুনরায় চুল গজায়। তবে তা আগের অবস্থায় যেতে এক বছর পর্যন্ত
সময় লাগতে পারে।
* ক্যানসার চিকিৎসায় কেমোথেরাপি দেওয়ার পর চুল
উঠে যায়। কেমোথেরাপির প্রথম ডোজ দেওয়ার দুই-তিন সপ্তাহ পর চুল পড়া শুরু হয় এবং কেমোর সর্বশেষ
ডোজের তিন-চার মাস পর পুনরায় চুল গজানো শুরু হয়।
* চুলের বিশেষ কোনো স্টাইলের জন্য যদি দীর্ঘদিন
খুব টেনে চুল বাঁধা হয় বা টাইট করে খোঁপা বা ব্যান্ড করা হয়, তবে এ ধরনের চুল পড়া শুরু হয়। দীর্ঘদিন এক রকম চুল বাঁধার কারণে চুল পড়া
পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরে যায় না। ফলে টেনে বাঁধার কারণে এ চুল পড়া স্থায়ীভাবে চুল পড়ার কারণ হয়ে
দাঁড়ায়। খুব বেশি পরিমাণে চুল রঙিন করার প্রসাধন, চুল সোজা করা বা ক্রমাগত রিবন্ডিং করলে চুল পড়ার হার বেড়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে আবার
চুল ওঠে, কিন্তু অনেক সময় হেয়ার ফলিকলের (যে গ্রন্থি
থেকে চুল হয়) স্থায়ী ক্ষতি হয়ে গেলে চুল আবার নাও গজাতে পারে।
* কিছু অসুখে যেমন: অ্যানিমিয়া, টাইফয়েড, জন্ডিস, ম্যালেরিয়া, ডায়াবেটিস ইত্যাদিতে
চুল পড়ে যেতে পারে। অনেক সময় অসুখ ভালো হওয়ার পরও চুল আর আগের অবস্থায় ফিরে যায় না।
* শরীরে বড় কোনো অস্ত্রোপচার বা অপারেশনের পর
বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ, শারীরিক পরিবর্তন অথবা মানসিক উদ্বেগের কারণে
অনেক সময় চুল পড়ে যেতে পারে। তবে সুস্থ হওয়ার পর চার থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে চুল আগের অবস্থায়
ফিরে যায়।
*•কোনো কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় চুল
পড়তে পারে, যেমন: জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি, প্রেসারের ওষুধ, রক্ত তরলীকরণের
ওষুধ, হরমোন, মানসিক অসুস্থতার ওষুধ ইত্যাদি।
*•টাক পড়ার ক্ষেত্রে বংশগত কারণও থাকতে পারে।
* ওপরের সমস্যাগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই প্রতিরোধযোগ্য। প্রতিরোধের সঠিক উপায়গুলো
জানা থাকলে আমরা সহজেই চুল পড়া রোধ করতে পারি। এতে কাজ না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
প্রতিরোধ
* পুষ্টিকর খাবার ও পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি খেতে
হবে। প্রয়োজনীয় ভিটামিন
ও খনিজ গ্রহণ করুন।
* চুল খুশকিমুক্ত ও পরিষ্কার রাখুন।
* দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন যাপন করতে হবে।
* বয়সের সঙ্গে চুলের রং পরিবর্তন হয়,
এটা মেনে নিতে হবে। কলপ, কৃত্রিম রং যতটা সম্ভব
এড়িয়ে চলুন।
* কোঁকড়া চুল সোজা করার চেষ্টা না করাই ভালো। প্রয়োজনে রাসায়নিকের
পরিবর্তে রোলার ব্যবহার করুন।
* টেনে চুল বাঁধা ঠিক নয়। আস্তে চুল আঁচড়াবেন
এবং ভেজা চুল বেশি আঁচড়াবেন না। নরম থাকতে চুল ঠিক করুন। ব্রাশের চেয়ে দাঁতওয়ালা চিরুনি ব্যবহার করা
ভালো।
* চুলের ধরন বুঝে শ্যাম্পু ব্যবহার করবেন।
* যেকোনো ওষুধ গ্রহণের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ
নিতে হবে।
No comments:
Post a Comment